❝দুনিয়াতে যত ভালো ও সাওয়াবের কাজ আছে তার সবই এই ৮টি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে❞শাকীক বলখি রহ.। হিজরি ২য় শতকের খ্যাতনামা সাধক পুরুষ। দুনিয়াবিমুখ সাধনা, তাকওয়া আর আমল ইবাদাতে যিনি সময়ের সেরাদের একজন। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন এসে শাইখের সান্নিধ্যে পড়ে থাকেন। এ যেনো আসহাবুস সুফফার অনুসারী দল। এ দলেরই একজন হাতিম আসাম রহ.। পরিচিত জন ডাকেন আবু আব্দির রহমান। ইমাম যাহাবির মতে হাতিম আসাম রহ.-কে বলা হয় এই উম্মাতের লুকমান হাকীম। [১]৩৩ বছর যাবত তিনি শাইখ শাকীক বলখির সান্নিধ্যে আছেন। প্রতিনিয়ত শিখছেন। নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ছেন। একদিন ডাক পড়ল হাতিম আসামের। আবু আব্দির রহমান, তোমার সাথে আমার এই পথ চলা কতদিনে গড়ালো? ৩৩ বছর। বলো কি, ৩৩ বছর? জি শাইখ। তা এই ৩৩ বছরে কী কী শিখলে শুনি। ৮ টি বিষয় শিখেছি। কয়টি? ৮ টি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রজিউন! জীবনটা তো প্রায় তোমার সাথেই কেটে গেলো। আর তুমি কিনা মাত্র ৮ টি বিষয় শিখেছ? আফসোস। আসলে আমি এই ৮ টি বিষয়ই শিখেছি। এখন মিথ্যা বলা তো আর সম্ভব না। আচ্ছা, বলো দেখি কী সেই ৮ টি বিষয়, যা তুমি এতদিনে শিখলে। জি বলছি। ❑১❑ আমি লক্ষ্য করে দেখলাম প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে ভালোবাসে। এর সাথে অন্তর জুড়ে দেয়। কিন্তু মৃত্যু এসে তার আর তার প্রিয়তমের মধ্যে বিভাজন এঁকে দেয়। দু’জনকে আলাদা করে দেয়। কবরে সে তার প্রিয়কে পাশে পায় না। আমি তাই ভেবে চিন্তে নেক আমলকে ভালোবাসতে লাগলাম। এতে আমি যখন কবরে যাব, আমার ভালোবাসাও আমার সাথে যাবে। বিচ্ছেদের কোনো সুযোগ নেই। ❑২❑ আমি দেখলাম, কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,وَاَمَّا مَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّهٖ وَ نَهَى النَّفۡسَ عَنِ الۡهَوٰىۙ ﴿۴۰﴾ فَاِنَّ الۡجَـنَّةَ هِىَ الۡمَاۡوٰىؕ আর যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করেছে এবং খেয়াল-খুশী থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখেছে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত। [২]এই আয়াত পড়ে আমি অন্তরকে প্রবৃত্তির আনুগত্য ছেড়ে আল্লাহর অনুগত হতে বাধ্য করেছি। ❑৩❑ আমি দেখলাম, দুনিয়াতে প্রতিটি মানুষই পার্থিব প্রাচুর্য্যের পিছে ছুটছে। সম্পদ অর্জন, বৃদ্ধি আর সংরক্ষণ নিয়ে সবাই ব্যতিব্যস্ত। এদিকে আল্লাহ তাআলা বলেন, مَا عِنۡدَكُمۡ يَنۡفَدُ وَمَا عِنۡدَ اللّٰهِ بَاقٍ“তোমাদের কাছে যা আছে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং আল্লাহর কাছে যা আছে, তা বাকী (স্থায়ীভাবে) থাকবে।” [৩]তাই আমার যাবতীয় অর্জন দুনিয়াতে না রেখে আল্লাহর (রাস্তায় তাঁর) কাছে জমা করে দিয়েছি। যাতে আল্লাহর খাযানায় আমার বিশাল ধনভাণ্ডার সঞ্চিত থাকে। ❑৪❑ আমি লক্ষ্য করে দেখলাম, নশ্বর এই দুনিয়ায় প্রত্যকেরই গর্ব-দম্ভের কিছু না কিছু আছে। কেউ সম্পদ নিয়ে গর্ব করে তো কেউ বংশ মর্যাদা নিয়ে দম্ভ প্রকাশ করে। কেউ শক্তি সামর্থ্য নিয়ে গর্ব করে তো কেউ নেতৃত্ব কর্তৃত্ব নিয়ে দম্ভ করে বেড়ায়। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, اِنَّ اَكۡرَمَكُمۡ عِنۡدَ اللّٰهِ اَ تۡقٰٮكُمۡ“নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে যে অধিক তাকওয়াবান (আল্লাহভীরু), সেই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাবান।”[৪]অতএব আল্লাহ তাআলার নিকট মর্যাদাবান হওয়ার লক্ষ্যে আমি তাকওয়াকে বেছে নিলাম। ❑৫❑ আমি গভীর উদ্বেগ নিয়ে লক্ষ্য করলাম, মানুষ একে অপরের নিন্দা করে বেড়ায়। অন্যের অর্জনের প্রতি ঈর্ষা আর প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে ওঠে। এর মূল কারণ হল সম্পদ, প্রাচুর্য্য ও বিদ্যার তারতম্য। অথচ আল্লাহ তাআলা বলে দিয়েছেন, نَحۡنُ قَسَمۡنَا بَيۡنَهُمۡ مَّعِيۡشَتَهُمۡ فِى الۡحَيٰوةِ الدُّنۡيَا وَرَفَعۡنَا بَعۡضَهُمۡ فَوۡقَ بَعۡضٍ دَرَجٰتٍ“আমি পার্থিব জীবনে তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বন্টন করে দিয়েছি এবং একের মর্যাদাকে অপরের উপর উন্নীত করেছি।” [৫]এই আয়াত আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, পার্থিব জীবনের সবকিছু আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত। তাই আমি অন্যের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ, আক্ষেপ ও ঈর্ষা বাদ দিয়ে তাকদীরের ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট আছি। ❑৬❑ আমি দেখলাম, দুনিয়াতে প্রায় প্রতিটি মানুষেরই কারও না কারও সাথে শত্রুতা আছে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ শত্রুর ব্যাপারে খুব সতর্ক। শত্রুকে ঘায়েল করার ফন্দিতে ব্যস্ত। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, اِنَّ الشَّيۡطٰنَ لَـكُمۡ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوۡهُ عَدُوًّا“নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের শত্রু, অতএব তোমরা তাকে শত্রু রূপেই গ্রহণ কর।” [৬]তাই সমস্ত সৃষ্টির সাথে শত্রুতা ত্যাগ করে একমাত্র শয়তানের বিরুদ্ধে শত্রুতা শুরু করেছি। তাকে পরাস্ত করাই এখন আমার ধ্যান জ্ঞান।❑৭❑ আমি দেখলাম মানুষ রুটি রুজির জন্য চেষ্টার কোনো অন্ত রাখছে না। নিজের মান সম্মান ধূলোয় লুটিয়ে দিয়ে রুটি রুজির পিছে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে হালাল হারামের পার্থক্য জ্ঞানটুকুও খুইয়ে বসে আছে। এদিকে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, وَمَا مِنۡ دَآ بَّةٍ فِى الۡاَرۡضِ اِلَّا عَلَى اللّٰهِ رِزۡقُهَا
“আর পৃথিবীতে এমন কোন বিচরণশীল প্রাণীনেই, যার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নেননি। (অর্থাৎ সকলের রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর।)” [৭]এই আয়াত পড়ে আমি জেনে গেলাম যে, আমার রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর। তিনি নিজেই এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। অতএব আমি যাবতীয় লোভ লালসা আর দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে তাঁর ইবাদাতে মনোনিবেশ করলাম। ❑৮❑ আমি খেয়াল করে দেখলাম, প্রতিটি মানুষই কারও না কারও প্রতি আস্থা ও ভরসা রেখে চলে। বিপদে আপদে, সুখে-দুখে যে কোনো অবস্থায় সে তার আস্থা ও ভরসার পাত্রের নিকট ছুটে যায়। সে মনে করে আমার যে কোনো সমস্যা হলে অমুক আছে। তিনি সব সামলে নিবেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আমাকে উদ্ধার করবেন। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمَنۡ يَّتَوَكَّلۡ عَلَى اللّٰهِ فَهُوَ حَسۡبُهٗ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بَالِغُ اَمۡرِهٖ ؕ قَدۡ جَعَلَ اللّٰهُ لِكُلِّ شَىۡءٍ قَدۡرًا “আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন।” [৮]অতএব আমি আল্লাহ তাআলার প্রতি আস্থা ও ভরসা রাখলাম তিনিই আমার জন্য যথেষ্ট। তিনিই আমার উত্তম অভিভাবক। শকীক বলখী রহ. এতক্ষণ তম্ময় হয়ে শিষ্যের কথা শুনছিলেন। হাতিম আসাম রহ. থামতেই তিনি ওঠে এসে শিষ্যকে জড়িয়ে ধরলেন। বারাকাল্লাহ বেটা, আল্লাহ তোমাকে এই পথে চলার তাওফীক দান করেন। সত্যি বলতে এই জীবনে আমি তাওরাত, ইনজিল, যাবূর আর কুরআনের যত ইলম হাসিল করেছি; তার আলোকে বলছি, দুনিয়াতে যত ভালো ও সাওয়াবের কাজ আছে তার সবই এই ৮টি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে। হলফ করে বলতে পারি, কেউ যদি এই ৮টি বিষয়ের ওপর আমল করে সে যেনো সমস্ত আসমানী কিতাব অনুযায়ী আমল করল। [৯]তথ্যসূত্রঃ [১] – তারীখুল ইসলাম, ১৭/১১৮ (৮৯)।[২] – সূরা নাযিয়া ৭৯:৪০,৪১ [৩] – সূরা নাহল ১৬:৯৬[৪] – সূরা হুজরাত ৪৯:১৩ [৫] – সূরা যুখরুফ ৪৩:৩২ [৬] – সূরা ফাতির ৩৫:৬ [৭] – সূরা হূদ ১১:৬ [৮] – সূরা ত্বলাক ৬৫:৩ [৯] – ইমাম গাযালী; ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, ১/৬৫,৬৬।
