মহান আল্লাহ তায়ালার সিফাত

আল্লাহ্ তায়ালার সিফাত সম্পর্কে মৌলিক কিছু কথাঃ

✍️ মুফতী বেলাল বিন আলী হাফিজাহুল্লাহ্।


আমরা আল্লাহ্ তায়ালার সাথে সম্পৃক্ত শব্দ গুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করতে পারি ।

১ – যে সকল শব্দ আল্লাহ্ তায়ালার মাঝে কোন ত্রুটি বা অসম্মান বুঝাবে, সে সকল শব্দ গুলোকে অবশ্যই তাবীল বা ব্যাখ্যা করতে হবে ।

যেমন আল্লাহ্ তালা বলেনঃ
نَسُوا اللَّهَ فَنَسِيَهُمْ

অর্থঃ তারা আল্লাহ্ তায়ালাকে ভুলে গিয়েছে । ফলে আল্লাহ্ তায়ালাও তাদের ভুলে গিয়েছেন । ( সূরা – তাওবা – ৬৭ )

উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ্ তালার সাথে “ভুলে” যাওয়া শব্দটি ব্যবহার হয়েছে সুতরাং এখন কেউ যদি বলেনঃ “আল্লাহ্ তায়ালাও ভুলে যান”, তাহলে এটা জায়েজ হবে না ।
কারণ ভুলে যাওয়া একটি ত্রুটি আর আল্লাহ্ তায়ালা অবশ্যই সকল ত্রুটি থেকে চির পবিত্র । সুতরাং অবশ্যই এখানে ভুলে যাওয়া শব্দটিকে তাবীল করতে হবে ।
অনুরূপ আল্লাহ্‌ তায়ালা সর্বোত্তম “চক্রান্তকারী” অথবা আল্লাহ্‌ তায়ালাও তাদের সাথে “উপহাস” করেন । এজাতীয় সকল শব্দই এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত । অর্থাৎ অবশ্যই শব্দ গুলোকে তাবীল বা ব্যাখ্যা করতে হবে কেননা শব্দ গুলো ত্রুটি বা অসম্মান বোঝায় ।

২ – যে সকল শব্দ আল্লাহ্ তায়ালাকে সৃষ্টির সদৃশ বোঝায় ( যেমন, হাত, পা, চোখ, কোন স্থানে থাকা ইত্যাদি ) এজাতীয় শব্দ গুলোকে আল্লাহ্‌ তায়ালার সিফাত হিসাবে সাব্যস্ত করা হবে এবং শব্দ গুলোর বাহ্যিক বা শাব্দিক অর্থ থেকে আল্লাহ্ তায়ালাকে চির পবিত্র মনে করা হবে ।

এই প্রকারটা ভালোভাবে বোঝার জন্য আগে উদাহরণ দুটি বোঝার চেষ্টা করুন । ( আল্লাহ্‌ তাওফিক দান করুন । আমিন )
এটা শুধুই বোঝার জন্য উদাহরণ । আল্লাহ্ তায়ালার সাথে সাদৃশ্য দেওয়া নয় । নাউজুবিল্লাহ ।

যেমন আমি আপনাকে বললামঃ পুরো বাংলাদেশের ক্ষমতা এখন আপনার “হাতে” ।
আমার এই কথার উদ্দেশ্য মোটেও এটা নয়, “আপনার হাত আছে”, এটা বোঝানো । বরং আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আপনার ক্ষমতার ব্যাপকতা বুঝানো ।

এবার আপনি কোরআনের এই আয়াতটি নিয়ে চিন্তা করুন ।
আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ

অর্থঃ বরকতময় ঐ সত্ত্বা যার “হাতে” সর্বময় কর্তৃত্ব । ( সূরা – মূলক – ১ )

এই আয়াতটি নিয়ে চিন্তা করলে দেখবেন, এখানে আল্লাহ্ তায়ালার উদ্দেশ্য এটা বুঝানো নয়, হে বান্দা ! জেনে রাখো, আমার “হাত” আছে । বরং আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ্ তায়ালার ক্ষমতার ব্যাপকতা বুঝানো ।

আরেকটি উদাহরণঃ
আপনার বাবা আপনাকে বললেনঃ কাজটি তুমি আমার চোখের সামনেই করো ।
এই কথা দ্বারা আপনার বাবার উদ্দেশ্য মোটেও এটা বুঝানো নয়, যে তার চোখ আছে । বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে, আপনি কাজটি তার তত্বাবধানে বা তিনি যেভাবে বলছেন, সেভাবে করুন ।

এবার আপনি কোরআনের এই আয়াতটি নিয়ে চিন্তা করুন ।
আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
وَاصْنَعِ الْفُلْكَ بِأَعْيُنِنَا

অর্থঃ আর তুমি আমার “চোখের” সামনে কিশতি তৈরি কর । ( সূরা – হূদ – ৩৭ )

উল্লেখিত আয়াতটি নিয়ে আপনি চিন্তা করলে দেখবেন, এখানেও আল্লাহ্ তালার উদ্দেশ্য এটা বুঝানো নয়, হে বান্দা ! জেনে রাখো, আমার চোখ আছে । বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ্ তায়ালা যেভাবে আদেশ করছেন, সেভাবে করুন ।

যত আয়াতে হাত, চোখ, চেহারা ইত্যাদি শব্দ গুলো আল্লাহ্ তায়ালার সাথে ব্যবহৃত হয়েছে, সে সকল আয়াত নিয়ে চিন্তা করলে দেখবেন, এখানে আল্লাহ্ তায়ালার জন্য শারীরিক বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সাব্যস্ত করা উদ্দেশ্য নয় বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে আয়াতের মূল বক্তব্যকে জোরদার করা ।

সিফাতের এই প্রকারকে কেন্দ্র করে ইসলামে কয়েকটি বাতিল ফিরকা বা দল তৈরি হয়েছে । যেমনঃ

ক – মুতাজিলা এবং জাহমিয়া ।
তারা যখন দেখলো, আল্লাহ্‌ তায়ালার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে এমন কিছু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যা দৈহিক বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বোঝায় এবং আকিদা হল, আল্লাহ্‌ তায়ালা দৈহিক বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে চির পবিত্র । তখন তারা ঢালাওভাবে শব্দগুলোকে তাবীল বা ব্যাখ্যা করলেন এবং শব্দ গুলোকে আল্লাহ্‌ তায়ালার সিফাত হওয়াতে অস্বীকার করলেন । নাউজুবিল্লাহ ।

খ – মুজাসসিমা এবং মুশাব্বীহা ।
তারা উল্লেখিত শব্দগুলোকে তার শাব্দিক বা বাহ্যিক অর্থ ধরে আল্লাহ্ তায়ালার জন্য দৈহিক বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সাব্যস্ত করে দিলেন । নাউজুবিল্লাহ ।
নামধারী সালাফী বা আহলে হাদিসরা এই মুজাসসিমা বা দেহবাদী আকিদার বংশধর । এজন্য এরাও তাদের পূর্বসূরীদের মত বলেনঃ আল্লাহ্ তায়ালার হাত, চেহারা, চোখ, ইত্যাদি আছে ।

আহ্লুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের অবস্থান উভয়ের মাঝামাঝিঃ
জেহুতু শব্দ গুলো আল্লাহ্‌ তায়ালার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে সুতরাং আল্লাহ্‌ তায়ালার বিভিন্ন সিফাতের মত, এই শব্দ গুলোও আল্লাহ্‌ তায়ালার সিফাত ।
জেহুতু আল্লাহ্‌ তায়ালা দৈহিক বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে চির পবিত্র সুতরাং এই শব্দ গুলোর শাব্দিক বা বাহ্যিক অর্থ আল্লাহ্‌ তায়ালার ক্ষেত্রে অসম্ভব ।

খোলাসাঃ আহ্লুস সুন্নাত ওয়াল জামাত, এজাতীয় শব্দ গুলোকে আল্লাহ্‌ তায়ালার সিফাত হিসাবে সাব্যস্ত করেন কিন্তু শব্দ গুলোর শাব্দিক বা বাহ্যিক অর্থ থেকে আল্লাহ্‌ তায়ালাকে চির পবিত্র মনে করেন ।

তবে মুজাসসিমা এবং মুশাব্বীহা ফেরকার আবির্ভাবের পর আহ্লুস সুন্নত ওয়াল জামাতের পরবর্তী ইমামদের কেউ কেউ সাধারণ মানুষদেরকে মুজাসসিমাদের দেহবাদী আকিদা থেকে ফিরানোর উদ্দেশ্যে, এই প্রকারের কিছু শব্দকে শর্ত সাপেক্ষে তাবীল করেছেন ।
( তাবীল এবং তার শর্ত নিয়ে আমি “সালাফিদের সালাফ বিরোধী আকিদাতে” আলোচনা করেছি । আলহামদুলিল্লাহ্ )

৩ – কিছু শব্দ আছে, যে শব্দগুলোর পারিভাষিক অর্থ আল্লাহ্ তায়ালার জন্য সাব্যস্ত হবে । কিন্তু শব্দগুলোর আভিধানিক অর্থ সাব্যস্ত হবে না ।

বিভিন্ন আয়াত এবং হাদিসে আল্লাহ্ তায়ালার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে “দয়া করা” এবং “সন্তুষ্ট বা খুশি হওয়া” এবং “রাগ করা” ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হয়েছে ।
এজাতীয় শব্দগুলোর পারিভাষিক অর্থ আল্লাহ্ তায়ালার জন্য সাব্যস্ত হবে কিন্তু আভিধানিক অর্থ না । অর্থাৎ রাগের সময় বা খুশির সময় মানুষের অভ্যন্তরীণ একটি পরিবর্তন আসে । এই পরিবর্তনকে আল্লাহ্ তায়ালার জন্য সাব্যস্ত করা যাবে না ।

যেমনঃ আপনি কারো প্রতি দয়ালু হওয়ার অর্থ হল, আপনার মাঝে দুটি জিনিস পাওয়া যাওয়াঃ
ক – দয়া বা অনুগ্রহ ।
খ – অন্তর এবং মস্তিষ্কের মাঝে একটা পরিবর্তন ।
আল্লাহ্ তায়ালার জন্য শুধু প্রথমটি সাব্যস্ত হবে । দ্বিতীয়টি সাব্যস্ত হবে না । কারণ আল্লাহ্ তালায়া মানুষের সদৃশ নয় । এবং আল্লাহ্ তায়ালা দেহ থেকে চির পবিত্র ।

৪ – কিছু শব্দ আছে, যে শব্দগুলোর শুধু আভিধানিক অর্থ, পূর্ণতার সাথে আল্লাহ্ তায়ালার জন্য সাব্যস্ত হবে ।
যেমন, জীবন, মর্যাদা, জ্ঞান, ক্ষমতা, দেখা, শোনা, ইত্যাদি ।

বিভিন্ন আয়াত এবং হাদিসে উল্লেখিত শব্দ গুলো আল্লাহ্‌ তায়ালার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে । অনুরূপ শব্দ গুলো মানুষের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয় ।
যেমনঃ আল্লাহ্ তায়ালার ক্ষমতা আছে অনুরূপ মানুষেরও ক্ষমতা আছে ।
কিন্তু উভয়ের মাঝে পার্থক্য হল, মানুষের ক্ষমতা সকল কিছুর উপর নয় । কিন্তু আল্লাহ্ তায়ালার ক্ষমতা সকল কিছুর উপর ।

অনুরূপ আল্লাহ্ তায়ালাও জানেন এবং মানুষও জানেন ।
কিন্তু উভয়ের জানার মাঝে পার্থক্য হল, মানুষের জানা অপূর্ণ এবং সীমাবদ্ধ কিন্তু আল্লাহ্ তালার জানা পূর্ণ এবং অসীম ।

অর্থাৎ এই প্রকারের সিফাত গুলো যেমন আল্লাহ্‌ তায়ালার সাথে ব্যবহার হয়, তেমনি মানুষের সাথেও ব্যবহার হয় । কিন্তু উভয়ের মাঝে পার্থক্য থাকে, পূর্ণতা এবং অপূর্ণতার জায়গায় ।

উল্লেখিত চারটি ভাগ স্মরণে রেখে আকিদার কিতাব মুতালা করলে, আমার মনে হয় ইন শা আল্লাহ্‌ অনেক ইশকাল বা আপত্তির জবাব নিজে নিজেই বোঝা সম্ভব।

আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের বিষয়টা ভালো করে বুঝার তাওফিক দান করুন । আমিন । এবং বাতিল অর্থ নেওয়া থেকে হেফাজত করুন । আমিন ।

جزاكم الله خيرا

Leave a comment